কুরআন শিক্ষার সহজ পদ্ধতি - 2022

কিংবদন্তী

কুরআন শিক্ষা পদ্ধতির কৌশলির কথা শোনো ।

আজ আমরা একজন কিংবদন্তী কৌশলির কথা জানবো । কৌশলি মানে কি জানো তো ? কৌশলি মানে হলো বৈজ্ঞানিক । বৈজ্ঞানিকের কাজ হলো নতুন কিছু উদ্ভাবন করা । উদ্ভাবন মানে হলো আবিষ্কার করা । তো আজকে আমরা যে বিজ্ঞানীর কথা বলবো তিনি কিন্তু কলকব্জা , কম্পিউটার , উড়োজাহাজ , যানবাহন , ঔষুধ - পত্র ইত্যাদি জিনিষ আবিস্কার করেননি । তিনি আবিস্কার করেছেন এমন কিছু , যা দুনিয়া ও আখিরাতে মানুষের কাজে লাগে বা উপকারে আসে । তাই তিনি হচ্ছেন একজন কুরআনি শিক্ষা পদ্ধতির কৌশলি বা বৈজ্ঞানিক ।

শুনে খুব অবাক হলে ? হ্যা , অবাক হবারই কথা । দুনিয়ার বিজ্ঞানীরা দুনিয়াতে কাজে লাগে এমন সব জিনিষ আবিস্কার করেন । কিন্তু আমাদের শ্রদ্ধেয় বিজ্ঞানী আবিস্কার করেছেন দুনিয়ার কাজে তো লাগবেই এবং পরকালে অর্থাৎ আখেরাতেও খুববেশি কাজে লাগবে । আর সে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় টাই আমাদের শ্রদ্ধেয় বিজ্ঞানী আবিষ্কার করে দুনিয়া বাসীকে তাক লাগিয়ে দিয়েছেন যে , কেমন করে খুব সহজে পবিত্র কুরআনুল কারীম শেখা যায় । তার বিস্ময়কর এই আবিস্কারের নাম হলো ; ‘ নূরানী কুরআন শিক্ষা পদ্ধতি ' ।




তাই তো এই মহৎ মনীষীকে জ্ঞানী - গুনীরা মেনে নিয়েছেন শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ শিক্ষা পদ্ধতির উদ্ভাবক হিসাবে । আর তাঁর ইন্তেকালের পর তাঁকে মরোনোত্তর শাইখুল কুরআন উপাধীতেও ভূষিত করা হয়েছে । এতক্ষণে নিশ্চয় তার নামটি জানার জন্য তোমাদের মনের মাঝে আকুপাকু করতে শুরু করেছে , তাইনা ! থাক আর টেনশন করে কাজ নেই , নামটা বলেই দিচ্ছি । এই মহামনীষীর নাম হলো শাইখুল কুরআন আল্লামা ক্বারী বেলায়ত হুসাইন রহ .। তিনি ১৯১০ ঈশায়ী সনে চাঁদপুর জেলার শাহরাস্তি উপজেলাধীন দক্ষিণ সূচীপাড়া ইউনিয়নের কৃষ্ণপুর গ্রামে এক সম্মানিত মুসলিম দ্বীনি পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন । বর্তমানে তার সম্মানে ওই গ্রামের নাম বেলায়েতনগর রাখা হয়েছে ।

তাঁর মায়ের নাম সাইয়েদা খাতুন এবং বাবার নাম মুন্সী আব্দুল জলীল । বাবা ছিলেন অত্যন্ত খোদাভীরু ও সৎ মানুষ । তারা কুরআনুল কারীম খুব ভালোবাসতেন । তাদের দুই কন্যাসন্তান জন্মানোর সু - দীর্ঘ ১৮ বছর পর বেলায়েত হুসাইনের জন্ম হয় । তার জন্মের মাত্র তিন বছর পর প্রিয় পিতা , এবং ছয় বছর পর গর্ভধারিনি মাতা নশ্বর পৃথিবী ছেড়ে চলে যান । মজার কথা হলো , জন্মের বহু আগে থেকেই তাঁর বাবা তার জন্য বিখ্যাত মুফাস্সির আল্লামা শাহ্ রফী উদ্দিন দেহলভী রহ . এর " উর্দু তরজমা কুরআনে মাজীদ " কিনে রেখেছিলেন । এছাড়াও শাইখুল কুরআন নিজের পারিবারিক জীবনের বহু আশ্চর্য ঘটনা রয়েছে । তার অংশ হিসাবে একটি ঘটনা শোন , তিনি দুটি বোম্বাই মরিচ গাছের চারা রোপন করেন । তখন তিনি অনেক অসুস্থ অবস্থায় বেচে থাকার আসা ছেড়ে নিজের স্ত্রীকে বলেন , আমার মৃত্যুর পর তুমি আমাদের সন্তানাদি নিয়ে কী ভাবে জীবন ধারন করবে ? প্রতিত্তোরে বল্লেন ! আপনি আমাকে নসিহত করুন । শাইখুল কুরআন ..... এ আয়াত এর কথা বলে নসিহত করলেন । দুনিয়াতে মানুষ আল্লাহর কাছে চাইলে আল্লাহ দেন , কিন্তু চাওয়ার সাথে কোন শরীক বা দৃঢ়তার অভাব থাকা চলবেনা ।

অতঃপর বলেন , তোমার নিকট যা থাকবে তাতেই সন্তুষ্ট থাকবে । কোন মানুষের থেকে ধার বা হাওলাত নিবেনা , কোন মানুষকে অভাবের কথা বলবেনা । তোমার কাছে কোনকিছু না থাকলেও একমাত্র আল্লাহ তা'আলা ছাড়া কারো নিকট চাইবেনা । প্রয়োজনে ঘরের দরজা বন্ধ করে নাখেয়ে শুধু আল্লাহ পাক এর সাহায্যের অপেক্ষা করবে । আর ঠিক সে ভাবেই শাইখুল কুরআনের স্ত্রী আমল শুরু করলেন । যে দিন সকল আহারের ব্যবস্থা শেষ , সম্মানের রিজিকের জন্য দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হলেন , কোন ভাবেই মানুষের সাহায্য চাইবোনা । আজ আর ঘরের দরজা খোলা হবেনা । তাই ছোট ছোট সন্তানরা ঘুম থেকে উঠার পূর্বেই ঘরের আঙ্গিনা ঝাড়ু দিয়ে ফেলবেন । বাদ ফজর দেখেন সেই বোম্বাই মরিচ গাছেই মরিচ ধরে ঝুলে আছে । আর আল্লাহ পাক সে ভাবেই সম্মানের সাথে রিজকের ব্যবস্থা করেদেন । এভাবেই ৮ মাস পর্যন্ত পরিবারের সকল খরচ মিটিয়ে বেশ কিছু অর্থ জমা করে ফেলেন । উল্লেখ্য : প্রতিদিন আড়াই শত মরিচ আড়াই টাকা করে বাড়ী থেকেই বিক্রি হয়ে যেত , কারন তখন মরিচের খুব অভাব ছিল । শাইখুল কুরআন প্রচন্ড অসুস্থতা নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন নূরানী শিক্ষা পদ্ধতির প্রচার প্রসারে ৮ মাস পর বাড়ী এসে দেখেন , পরিবার খুব সুন্দর চলছে । কিন্তু কি ভাবে চললো তা জানতেই কেদে কেদে আফসোস করে বলেন আমি যদি গত ৭ মাসের মত ওজিফা গ্রহণ না করতাম তাহলে হয়তো আল্লাহ পাক এভাবেই পারিবারিক সকল খরচ চালাইতে থাকতেন । এবং বলেন যেদিন থেকে তিনি কিছু অজিফা গ্রহণ করেন , সেদিন থেকেই মরিচ ধরা কমতে থাকে ।

পারিবারিক জীবনে তিনি জান্নাতুল ফেরদাউস ( রহ . ) - কে বিবাহ করেন [ ২০১৯ / ০৯ / ১৮ ইং দিবাগত রাত ১১:৪৫ মিনিট তিনিও ইহলোক ত্যাগ করেন । তাঁদের তিন কন্যা ও ছয় পুত্র সন্তান রেখে যান । ছেলেরা সকলেই হাফেজে কুরআন ও আলেমে দ্বীন । তারা সবাই ‘ নূরানী পদ্ধতিতে কুরআন শিক্ষার প্রচার - প্রসারের কাজ করেন । ছোট্টবেলায় ইয়াতিম বেলায়েত হুসাইন আপন চাচার নিকট প্রাথমিক শিক্ষা নিতে চাচার সাথেই ঢাকায় আসেন । কোন সুযোগ না পেয়ে দু'বছর পর খালাতো বোনের বাড়িতে লেখা - পড়া করার আসায় গমন করেন । কিন্তু তখনও শিক্ষা জীবন শুরুই করতে পারেননি । অবশেষে তার বড়বোন বাবার কেনা সেই কুরআনুল কারীমের তারজুমা গ্রস্থ দেখিয়ে কেঁদেকেটে বেলায়েতকে বাবার ইচ্ছার কথাটি বলেন । তিনি ভাইকে সোজা চাঁদপুর জেলার ফরিদগঞ্জের বারপাইকা মাদরাসায় চলে যাওয়ার পরামর্শ দেন । বড়বোনের অনুরোধ মেনে নিয়ে তিনি বারপাইকা মাদরাসায় প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করে ঢাকার বড়কাটারা আশরাফুল উলুম হুসাইনিয়া মাদরাসায় শিক্ষা জীবনের সমাপ্তি ঘটান । সুন্দর আচরণ , তীক্ষ্ণ মেধা , নির্মল চরিত্র ও দীপ্তিময় চেহারার কারণে ছাত্রজীবনেই তিনি শিক্ষকদের প্রিয়ভাজন হয়ে ওঠেন । সে সময় তিনি মুজাহিদে আযম আল্লামা শামসুল হক ফরিদপুরী রহ . আমীরে শরীয়ত মুহাম্মাদুল্লাহ হাফেজ্জী হুজুর , পীরজী হুজুর রহ . ও মুহাদ্দিস হেদায়েত উল্লাহ সাহেবদের মত সময়ের শ্রেষ্ঠ ' আসাতেজা ' গণের সান্নিধ্য লাভ করে ধন্য হন । আল্লামা শামসুল হক ফরীদপুরী রহ . ( সদর সাহেব ) তরুণ আলেম মাওলানা বেলায়েত হুসাইনকে স্বীয় মাদরাসা মধ্যদিয়ে সুযোগ্য করে গড়ে তোলেন । গওহরডাঙ্গায় শিক্ষক হিসাবে নিযুক্ত করেন । এবং নিজের কাছে রেখে ইলমি ও আমলি প্রশিক্ষণের মধ্যদিয়ে সুযোগ্য গড়ে তোলেন।

পরে মুজাহিদে আজম সদর সাহেব হুজুরের নির্দেশে মাওলানা বেলায়েত হুসাইন চাঁদপুর জাফরাবাদ হাফেজিয়া মাদরাসার মোহতামিম - এর দায়িত্ব গ্রহণ করেন । কয়েক বছরের মধ্যেই তিনি মাদরাসাকে সুনামধন্য প্রতিষ্ঠান হিসাবে প্রতিষ্ঠা করেন । এছাড়াও ঢাকার জামেয়া নূরিয়া কামরাঙ্গীচর মাদরাসাসহ বহু প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলে ও উন্নত শিক্ষা উপহার দিয়ে অনেক অনেক প্রশংসা কুড়ান ।

শাইখুল কুরআন আল্লামা ক্বারী বেলায়েত হুসাইন রহ . ছাত্রজীবনেই নিয়মিত তাহাজ্জুদ আদায় করতেন , তার নামাজ ছিল খুশুখুজু ও একাগ্রতায় ভরা জীবন্ত নামায যেন , সাহাবায়েকেরামের নামাযের প্রতিচ্ছবি !! তিনি ছিলেন প্রিয় নবীজি সা . - এর ইলমে নববীর সত্যিকারের ওয়ারিছ ।

ইলমেদ্বীন শিক্ষা করা প্রত্যেক মুসলমানের উপর ফরয নবীজির এই হাদীস শরীফ তাকে খুবই চিন্তিত করে তুলেছিল । তিনি ভাবতেন মাদরাসায় যারা দ্বীন শিখতে আসে তাদের সংখ্যা অনেক কম , আর যারা মাদরাসায় আসে না তাদের সংখ্যা অনেক বেশি । সমাজের এ বিশাল জনগোষ্ঠির কথা চিন্তা করে তিনি ব্যথিত ও মর্মাহত হতেন ।

তোমরা তো জানোই , পবিত্র কুরআন মাজীদ ও জরুরী দ্বীন শিক্ষা করা ছাড়া আখিরাতে মুক্তির কোন পথ নেই । তাছাড়া পুরো মুসলিম মিল্লাতকে জাহান্নামের আগুন থেকে রক্ষা করতে হলে দ্বীনি শিক্ষাও খুব প্রয়োজন । তাই তিনি মাদরাসার ১৩ বছরের শিক্ষকতা ছেড়ে পবিত্র কুরআনের জন্য নিজেকে উৎসর্গ করেন । শতভাগ মুসলিমের নাজাতের জন্য একটি সহজ - সরল ও ব্যপক গ্রহণযোগ্য কোন বৈজ্ঞানিক পথের সন্ধান করতে থাকেন । অবশেষে তিনি পবিত্র কুরআনের সুরা ক্বামার - এর ১৭ নম্বর আয়াতেই সে সন্ধান পেলেন । এই আয়াতে বলা হয়েছে- ' অবশ্যই আমি কুরআনকে অতিসহজ করে দিয়েছি উপদেশ গ্রহণের জন্য , অতএব উপদেশ গ্রহণকারী কে আছে কি ' ?

ওই আয়াতকে সামনে রেখে তিনি মহান রবের দরবারে দিনের পর দিন পরিশ্রম ও চোখের পানি পেশ করতে থাকলেন । দীর্ঘ দিনের শ্রম ও কাকুতি - মিনতির পর তিনি দয়াময় রাব্বে কারীমের রহমতে পবিত্র কুরআনুল কারীমের শিক্ষার সহজ পদ্ধতি আবিষ্কার করেন । ( আরো অনেক ঘটনা তোমরা তাঁর জীবনী গ্রন্থে পাবে ) । তার এই আবিস্কার - ই দুনিয়াজুড়ে ' নূরানী কুরআন শিক্ষা পদ্ধতি ' / ' নূরানী পদ্ধতি ' নামে সুখ্যাতি লাভ করেছে । এ পদ্ধতি বর্তমানে বাংলাদেশসহ বিশ্বমুসলিমের জন্য জরুরী দ্বীনশিক্ষা ও পবিত্র কুরআন মাজীদের বিশুদ্ধ তিলাওয়াত সহ নিরক্ষতা দূর করে অভূতপূর্ব পূর্নাঙ্গ প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থার এক অলৌকিক দুয়ার খুলে দিয়েছেন ।

মহাকালজয়ী কিংবদন্তি পুরুষ শাইখুল কুরআন আল্লামা ক্বারী বেলায়েত হুসাইন রহ . ১৪৩৮ হিজরীর ২৮ রমযান মুতাবেক ২০১৭ ঈশায়ী সনের ২৪ জুন , শনিবার দুপুর ১২ টা ২৫ মিনিটে ঢাকার মোহাম্মদপুরে দুনিয়ার সকল মায়া ত্যাগ করে রাব্বুল আলামীনের ডাকে সাড়া দিয়ে তাঁর সান্নিধ্যে চলে যান । ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন । তাঁর নিজের গ্রাম : বেলায়েতনগর , শাহরাস্তি , চাঁদপুরে তাঁকে সমাহিত করা হয় । নূরানী পদ্ধতির প্রতিষ্ঠিত প্রথম নূরানী মাদরাসা তাঁর নিজ হাতে প্রতিষ্ঠিত “ বেলায়েতনগর নূরানী ও হিফজ মাদরাসা প্রাঙ্গনেই চির নিদ্রায় শায়িত আছেন । আল্লাহপাক শাইখের মাক্ববারাকে নূরে নূরান্নিত করে দিন , আমিন । 

......................... ইসমাইল বেলায়েত হুসাইন

Post a Comment

Previous Post Next Post